ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৭:০৭:৪৪ পিএম

রাজস্ব আয় ও বিনিময় হারের শর্ত পূরণ হলে ঋণছাড়ের প্রস্তাব উঠবে পর্ষদে

২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৩:৪০ পিএম

রাজস্ব আয় ও বিনিময় হারের শর্ত পূরণ হলে ঋণছাড়ের প্রস্তাব উঠবে পর্ষদে

ছবি: সংগ্রহ

রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও মুদ্রা বিনিময় হারে আরো নমনীয়তা আনার বিষয়ে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জোর দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ-সংক্রান্ত শর্ত পূরণের পর সামনের বছরের ফেব্রুয়ারিতে সংস্থাটির পর্ষদে বাংলাদেশের জন্য ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের প্রস্তাব উঠবে। বাংলাদেশ সফররত আইএমএফ মিশন শেষে গতকাল আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।


অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সভাকক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন মিশনপ্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও এবং বাংলাদেশে সংস্থা‌টির আবাসিক প্রতি‌নি‌ধি জয়েন্দু দে। ঋণের কিস্তি ছাড়ের জন্য কোন সংস্কারগুলো গুরুত্বপূর্ণ, এমন প্রশ্নের জবাবে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ‘রাজস্ব আয় বৃ‌দ্ধি ও বি‌নিময় হা‌র নমনীয় করা-সংক্রান্ত শর্ত পূরণের বিষয়‌টি গুরুত্বপূর্ণ। এ দু‌টি শর্ত পূরণের পর আগামী ৫ ফেব্রুয়া‌রি আইএমএফের পর্ষদে আমরা প্রস্তাব পাঠা‌ব। এরপর পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ ঋণের কিস্তির অর্থ পাবে।’


ক্রিস পাপাজর্জিও আইএমএফের গবেষণা শাখার উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের প্রধান। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতি উৎসাহব্যঞ্জক নয়। উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমাদের আগের পূর্বাভাসে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বলা হলেও বর্তমানে তা ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আমাদের দৃষ্টিতে অর্থনীতি কতটা শ্লথ হয়ে পড়েছে তা এ পূর্বাভাস কমিয়ে আনার মাধ্যমেই স্পষ্ট।

 

আরেকটি দিক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় মূল্যস্ফীতি উচ্চ অবস্থানে রয়েছে এ দেশে। আর তা দুটি কারণে হয়েছে। একটি হচ্ছে, সরবরাহ পর্যায়ে যেটি আমরা মনে করি খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে হয়েছে। এক্ষেত্রে কাঠামোগত ইস্যু রয়েছে, যার কারণে উচ্চ খাদ্যমূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। আরেকটি চাহিদার কারণে যেখানে সামষ্টিক চাহিদা উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। নিম্ন প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। আমরা মনে করি, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি এক অংকে (৫-৬ শতাংশ) নেমে আসবে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।’

 

ব্যাংক খাতের অবস্থা ভয়াবহ উল্লেখ করে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ‘খেলাপি ঋণের বিষয়ে আইএমএফ বরাবরই উচ্চকণ্ঠ ছিল। ঋণ কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগে থেকেই আমরা জানতাম যে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক যে পরিমাণ প্রকাশ করা হতো খেলাপি ঋণ তার চেয়েও বেশি ছিল। তবে ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানাই।’

 

ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বৈদেশিক মুদ্রার বড় ধরনের ক্ষয় দেখেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক পর্যায়ে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জুলাই আন্দোলনের কারণেও অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একের পর এক আঘাত এসেছে। এ অবস্থায় অর্থায়ন ঘাটতি মেটাতে আইএমএফের পাশাপাশি অন্যান্য বহুজাতিক সংস্থাও এগিয়ে এসেছে। জলবায়ুজনিত কিংবা অন্য কোনো কারণে যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোনো আঘাত আসে তাহলে সেটি কাটিয়ে ওঠার জন্য যে অর্থায়ন প্রয়োজন সেটি আমাদের আছে।’

 

রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও বিনিময় হারে আরো বেশি নমনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে আইএমএফের মিশনপ্রধান বলেন, ‘ঋণ কর্মসূচি পর্যালোচনার সময় আমরা বেশকিছু সংস্কারকে গুরুত্ব দিই। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ইস্যু। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৭ শতাংশ, যা বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন। গত কয়েক মাসে এটি আরো নিচে নেমে গেছে। আমরা রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, যাতে সামাজিক ও মূলধন খাতে ব্যয় বাড়ানো যায়। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের পাশাপাশি উদীয়মান বাজার।

 

কিন্তু এত কম রাজস্ব আয় দিয়ে কোনো দেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও নিম্ন মূল্যস্ফীতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে এমনটি কোথাও আমরা দেখিনি। রাজস্ব আয় কম হওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে করছাড়ের সংস্কৃতি। এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে। এটি পরিবর্তনের জন্য আমরা বলেছি। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছারও প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে ডলারের আনুষ্ঠানিক দরের সঙ্গে বাজারদরের সামান্য ব্যবধান রয়েছে। এটিকে আরো নমনীয় করতে একটি পদ্ধতি চালুর জন্য আমরা সহায়তা করব, যাতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে না হয়।’

 

করনীতি ও প্রশাসন পৃথকীকরণের বিষয়ে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ‘এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এ বিষয়ে অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থা, যেমন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে। তারাও এ বিষয়ে সহায়তা করতে চায়। আমরা সরকারের কাছ থেকে এ নিয়ে রোডম্যাপ চেয়েছি। এটি বাস্তবায়নের জন্য কিছু আইনি সংস্কারেরও প্রয়োজন হবে। ঋণ কর্মসূচির আওতায় পরবর্তী পর্যালোচনার সময় আমরা এ পৃথকীকরণ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি পর্যালোচনা করব।’

 

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা উদ্বেগজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি ব্যাংক খাত থেকে মূলধন বেরিয়ে গেছে এবং আমরা এটি মূল্যায়ন করে দেখছি। বর্তমানে ছয় থেকে ১২টি ব্যাংক চাপের মধ্যে রয়েছে। এ ব্যাংকগুলো আমাদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছি। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য প্রয়োজন হলে সামনে নীতি সুদহার আরো বৃদ্ধির বিষয়ে গভর্নর আমাদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ অবস্থায় দুর্বল ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। সাময়িকভাবে এটি করা যেতে পারে, তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। একই সঙ্গে বাজার থেকে সমপরিমাণ অর্থ তুলে নেয়াও প্রয়োজন, যাতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে না পারে।’

 

ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন পর্যালোচনার জন্য ৩ থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইএমএফের একটি মিশন বাংলাদেশ সফর করে। এ সময় মিশনটির কর্মকর্তারা অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

 

এদিকে দেশের অর্থনীতি নিয়ে আইএমএফের মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে গতকাল সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আইএমএফ নানা শঙ্কার কথা বললেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এত খারাপ না, তবে চ্যালেঞ্জ আছে।’

 

প্রসঙ্গত ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদহার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। এবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরো বাড়তি ৭৫ কোটি ডলার ঋণসহায়তা চাওয়া হয়েছে। এতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৩০ কোটি ডলারে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং গত বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত জুনে তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার ছাড় করেছে সংস্থাটি। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত তিন কিস্তিতে ঋণের ২২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। চতুর্থ কিস্তিতে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাবে বাংলাদেশ।

রাজস্ব আয় ও বিনিময় হারের শর্ত পূরণ হলে ঋণছাড়ের প্রস্তাব উঠবে পর্ষদে