ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৪:৫৬:২৭ পিএম

লোডশেডিং মোকাবিলায় তেলের ওপর নির্ভরতা

৩ নভেম্বর, ২০২৪ | ৯:১৯ এএম

লোডশেডিং মোকাবিলায় তেলের ওপর নির্ভরতা

ছবি: সংগ্রহীত

কয়লা সংকটে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে, বকেয়া বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেক করে দিয়েছে ভারতের আদানি। অন্যদিকে এস আলমের বাঁশখালী (এসএস পাওয়ার) এবং রামপাল থেকেও আসছে সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কমে যাওয়ায় লোডশেডিং মোকাবিলায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। এতে বাড়ছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ।

 

 

দেশে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে শুধু পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে রয়েছে। পটুয়াখালীর এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে একটানা পূর্ণ সক্ষমতায় (কম-বেশি ১২৪৪ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ নিচ্ছে পিডিবি। গতকাল শনিবার দেশে দিনে-রাতে বিভিন্ন সময় সোয়া ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। এ সময়ে ২০০ থেকে ৭০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। যা আগের কয়েক দিনের তুলানায় কম ছিল। এর আগে শুক্রবার রাত একটায় দেশে সর্বোচ্চ ১৬৮৫ মেগাওয়াট এবং বৃহস্পতিবার রাতে সর্বোচ্চ ১৫৭৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছিল। এ ছাড়াও দিনে-রাতে বিভিন্ন সময় কম-বেশি লোডশেডিং ছিল।

 

 

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এক সপ্তাহ আগেও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সোয়া কোটি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) থেকে দেড় কোটি ইউনিটের মধ্যে ছিল। গত ২৫ অক্টোবর দেশে চাহিদার জোগান দিতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট/ঘণ্টা বা ১ কোটি ৩৭ লাখ ইউনিট। জ¦ালানি ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২৬ অক্টোবর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ১২ লাখ ইউনিট। জ¦ালানি ব্যয় হয় ৫৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। একদিনেই বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে উৎপাদনে খরচ বেড়ে যায় ৩১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। ২৭ অক্টোবর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৩ কোটি ৮৩ লাখ ইউনিট, ২৮ অক্টোবর উৎপাদন করা হয় ৪ কোটি ১৫ লাখ ইউনিট, ২৯ অক্টোবর ৪ কোটি ৫ লাখ ইউনিট এবং ৩০ অক্টোবর ছিল ৪ কোটি ৯ লাখ ইউনিট। এ সময় গ্যাস, কয়লা, তেল, সোলার, হাইড্রো (আমদানিসহ) অর্থাৎ সব ধরনের জ্বালানি মিলিয়ে মোট উৎপাদন ছিল ২৫৭ মিলিয়ন ইউনিট থেকে ২৮৫ মিলিয়ন ইউনিট।

 

 

দেশে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রা, বাগেরহাটের রামপাল ও চট্টগ্রামে এস আলমের বাঁশখালী এসএস পাওয়ারের স্থাপিত সক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে পায়রা কেন্দ্র গ্রিডে বিদ্যুৎ দিতে পারে ১২৪৪ মেগাওয়াট, রামপাল ১২৩৪ এবং এস আলম ১২২৪ মেগাওয়াট। আর মাতারবাড়ীতে স্থাপিত ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র গ্রিডে দিতে পারে ১১৫০ মেগাওয়াট।

 

 

চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে একমাত্র পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে রয়েছে। এনএলডিসির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে একটানা ১২০০-১২৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিচ্ছে পিডিবি।

 

 

বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) পায়রায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করে। মালিকানায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সমান (৫০ : ৫০) অংশীদারত্ব রয়েছে। পায়রার প্রথম ইউনিটটি ২০২০ সালের ১৫ মে এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি একই বছরের ৮ ডিসেম্বর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। তবে এভাবে একটানা পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন অব্যহত রাখা হলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎকেন্দ্র-সংশ্লিষ্টরা।

 

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট ২০২০ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। মেইনটেনেন্স পিরিয়ড ছাড়া পুরো সময় এই কেন্দ্র থেকে টানা বিদ্যুৎ নেওয়া হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে না। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রটি নির্মাতাদের (সিএমসি) সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা (চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান) বলেছে, ‘সাসটেইনেবল, প্রবলেম হবে না’।

 

 

পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৪ অক্টোবর মাতারবাড়ী থেকে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল ছিল। ওইদিন কেন্দ্রটি থেকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে ১৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কয়লার মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় পরদিন কেন্দ্রটির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

 

 

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে যথাক্রমে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০২৪ সালের জুলাইয়ে। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়ন এবং রাষ্ট্রীয় কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) অধীনে এই কেন্দ্রটি নির্মিত হয়।

 

 

এদিকে, কয়লার অভাবে উৎপাদন অর্ধেক কমেছে রামপাল ও বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এ সময় এস আলমের বাঁশখালীরও একটি ইউনিট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রামপাল নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে সম-অংশীদারত্বের ভিত্তিতে এই কোম্পানি গঠিত। এসএস পাওয়ার নির্মিত হয়েছে দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ এবং চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচটিজির যৌথ উদ্যোগে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে এস আলমের অধীনস্থ ৬টি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্ব ৭০ শতাংশ। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ চীনের দুই কোম্পানির।

 

 

অন্যদিকে, কয়লাভিত্তিক তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংকটকালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে ভারতের আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ড লিমিটেড (এপিজেএল)। সময়মতো বকেয়া বিল না পেয়ে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) তথ্যে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে আদানি প্ল্যান্ট অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। স্থাপিত সক্ষমতা ১৬০০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট থেকে বর্তমানে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ করছে। একই সক্ষমতার অপর ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। আদানির দাবি, পিডিবির কাছে তাদের ৮৮৬ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা) বকেয়া রয়েছে।

 

 

পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আদানি কয়লার দাম বেশি ধরে সেই টাকা পরিশোধ করতে বলছে। তবে কয়লার চড়া দাম দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে পিডিবি।

 

 

পিবির সূত্র বলছে, পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পিডিবির কাছ থেকে প্রতি টন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের এসএস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম ধরছে কম-বেশি ৮০ ডলার। আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম চাইছে ৯৬ ডলার। বাড়তি দাম নিয়ে বিরোধ ও বকেয়া পরিশোধের তাগিদের মধ্যে সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর পিডিবিকে চিঠি দেয় আদানি। এতে বলা হয়, পিডিবি যাতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়, নইলে আদানি ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী ৩১ অক্টোবর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে।

 

 

পিডিবি সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানির নামে ঋণপত্র (এলসি) খোলার কথা ছিল ৩০ অক্টোবরের মধ্যে। কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এটি খোলার কথা ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। পিডিবি আরও সময় চেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে একটি ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছে আদানি।

লোডশেডিং মোকাবিলায় তেলের ওপর নির্ভরতা