ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৫:১৪:০৬ পিএম

ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক

১৯ অক্টোবর, ২০২৪ | ১২:১৪ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

সাড়ে চারশ কোটি টাকার ময়লা-বাণিজ্য হাত বদল

১৯ অক্টোবর, ২০২৪ | ১২:১৪ পিএম

সাড়ে চারশ কোটি টাকার ময়লা-বাণিজ্য হাত বদল

ছবি: সংগ্রহীত

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি টাকার ময়লা বাণিজ্য হয়। আগে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলে সেই বাণিজ্যের অনেকটাই এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে বলে জানা গেছে।

 

 

বর্জ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দেওয়ার আগে সিটি করপোরেশন থেকে কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। শর্তাবলীর মধ্যে রয়েছে- এলাকার প্রতি বাসা-বাড়ি/ফ্ল্যাট থেকে মাসে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা এবং বিভিন্ন দোকান থেকে ৩০ টাকা হারে সেবামূল্য গ্রহণ করতে পারবে। কোনো অবস্থাতেই অতিরিক্ত সেবামূল্য গ্রহণ করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন। রাজধানীর বেশিরভাগ ওয়ার্ডে এ নির্দেশনা মানে না সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। সিটি করপোরেশনও এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং অবাধে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাড়তি বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগী নগরবাসীর।

 

 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) হিসাবে দুই সিটিতে মোট হোল্ডিং রয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৫টি। অধিকাংশ হোল্ডিংয়ে ৬ থেকে ১২টি করে ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। একটি হোল্ডিংয়ে গড়ে ৬টি ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। আর প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে গড়ে ১৫০ টাকা করে আদায় করা হয়। এই হিসেবে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে প্রায় ৩৬ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে; বছরে যা প্রায় ৪৩২ কোটি টাকা।

 

 

অন্যদিকে বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব মতে, রাজধানীতে সাত হাজারের বেশি রেস্তোরাঁ রয়েছে। প্রতিটি রেস্তোরাঁ থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। অভিজাত এলাকাগুলোতে এই টাকার পরিমাণ আরও বেশি। সাত হাজার রেস্তোরাঁ থেকে মাসে আদায় হচ্ছে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাসাবাড়ি ও হোটেল রেস্টুরেন্ট থেকে বছরে ৪৪৯ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।

 

 

আগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা এই বাণিজ্য করতেন। কোনো ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নিজ নামে অথবা অন্য নামে টেন্ডার নিতেন। আবার কোনো কোনো ওয়ার্ডে নিজেদের লোকদের দিয়ে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করাতেন। তবে টেন্ডারে যে প্রতিষ্ঠানই থাকুক, কাজ পেতেন কাউন্সিলরের লোকেরা। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলরদের অপসারণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে কাউন্সিলরদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো আর ময়লা সংগ্রহ করতে পারছিল না। সিটি করপোরেশনও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিপাকে পড়ে। তাছাড়া অনেক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদও শেষ পর্যায়ে ছিল। এ জন্য নতুন করে টেন্ডার দেয় দুই সিটি করপোরেশন। গত ১ অক্টোবর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরের জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয় ডিএসসিসি।

 

 

ডিএসসিসির ১ নম্বর ওয়ার্ডে আগে কাজ করত মেসার্স মা ট্রেডার্স। সেখানে এখন কাজ পেয়েছে দি কন্টিনেন্টাল বিল্ডার্স। একইভাবে ২ নম্বর ওয়ার্ডে নতুন কাজ পেয়েছে মেসার্স জীল করপোরেশন।

 

 

এ রকম প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিষ্ঠান বদলের মতো হাত বদল হয়েছে। তবে ময়লা বাণিজ্যের চিত্র বদলায়নি। দক্ষিণ সিটির ১ নম্বর ওয়ার্ডের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দি কন্টিনেন্টাল বিল্ডার্স। কাজ পেয়েছেন আবুল হাসান কিন্তু ১নং ওয়ার্ডের খিলগাঁও সি ব্লকে ভাই ভাই সংগঠনের রশিদে টাকা তোলেন আবুল হাসেম। তিনি প্রতিটি গাড়িতে ৩০ হাজার টাকা করে অগ্রিম চেয়েছেন। এই এলাকাতে ৩০-৩২টি গাড়ির মাধ্যমে বাসা-বাড়ি ও হোটেল রেস্তোরাঁর ময়লা সংগ্রহ করা হয়।

 

 

বাড়তি টাকা চাওয়ার বিষয়ে আজিজ নামে একজন সংগ্রাহক বলেন, আমাদের গাড়িপ্রতি ৩০ হাজার টাকা করে চাওয়া হয়েছে। আমরা যারা ময়লা সংগ্রহ করি, এত টাকা দিলে কীভাবে কাজ করব? তাই না করে দিয়েছি। এরপর বলেছে ১৫ হাজার করে দিতে হবে। এ জন্য কয়েকদিন ময়লা সংগ্রহ করা বন্ধ ছিল।

 

 

একইভাবে ডিএনসিসিতেও আগের লোকজন সব পরিবর্তন হয়েছে। উত্তরেও অলিখিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। নগর কর্তৃপক্ষ অনেকটা নিরুপায় ছিলেন এক্ষেত্রে। কাজ না দিলে এলাকা থেকে ময়লা সংগ্রহ বন্ধ করে দেওয়া হতো।

 

 

ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান বলেন, আগে ইনফরমালি নিয়ন্ত্রণ হতো ক্ষমতাসীনদের দ্বারা। সেটাকে আমরা একটা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আনতে প্রাথমিক বর্জ্য সংগ্রহ সেবা প্রদানকারী (পিসিএসপি) নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় যাচ্ছি। এর আগে ২০২২ সালে একবার নিবন্ধন হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন সেটা বন্ধ ছিল। আবার শুরু করেছি এবং টেন্ডারও দেওয়া হয়েছে।

 

 

এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা (উপসচিব) মোহাম্মদ নাছিম আহমেদ বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজ সুচারুরূপে করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করি। অনেকেই দরপত্রে অংশগ্রহণ করেছিল; তার মধ্যে থেকে যারা যোগ্য তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন কোনো দলকে দেখে দেয়নি। একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে। এই কাজ দেওয়ার সময় একটা বিষয় মাথায় রাখা হয় যে এলাকায় যে প্রতিষ্ঠানের প্রভাব তাদের দেওয়া হয়।

 

 

ঢাকার দুই সিটিতে মোট ওয়ার্ড ১২৯টি। এগুলোর মধ্যে ৯৩টি পুরাতন এবং ৩৬টি নতুন ওয়ার্ড। নতুন ওয়ার্ডগুলোতে সিটি করপোরেশনের অন্যান্য সেবা পুরোপুরি চালু না হলেও বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বাসা বাড়ি থেকে পিসিএসপির মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহ করে ১০০ টাকা করে নিলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও প্রতিবছর গৃহকরের ৩ শতাংশ নেয় পরিচ্ছন্নতা বাবদ। এই খাতে শত কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করে দুই সিটি করপোরেশন। যদিও নগর কর্তৃপক্ষ বলছে সিটি করপোরেশন সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থেকে গাড়ির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় বর্জ্যাগারে বর্জ্য ফেলা হয়। যে কোনো বর্জ্য এসটিএস-এ ফেলে গেলে কোনো টাকা দিতে হয় না। কিন্তু বাসা-বাড়ি থেকে সংগ্রহ করতে গেলে একটি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়। আর সেই সুযোগে এটা বাণিজ্যিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

 

 

প্রাপ্ত্য তথ্যমতে, ডিএসসিসির কাজ পেয়েছেন মো. সাজ্জাদুর রহমান মেসার্স জীল করপোরেশন নামক প্রতিষ্ঠানের হয়ে। ওয়ার্ড বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সাজ্জাদুর বলেন, টেন্ডারে আরও কয়েকজন অংশ নিয়েছিল। আমার সবকিছু ঠিক ছিল, আমি পেয়েছি। আমি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত; তাতে কি হয়েছে?

 

 

৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন মো. রানা। তার প্রতিষ্ঠানের নাম রাহা এন্টারপ্রাইজ। মো. রানা বলেন, আগে এখানে আওয়ামী লীগের রয়েল কাজ করত। ওরা এখন নাই। আমরা কাজ পেয়েছি। আপনিও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কিনা জানতে চাইলে বলেন, ধূর কি বলেন? আওয়ামী লীগের রাজনীতি কোনো মানুষ করে নাকি! ওরা তো পশু। আমি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

 

 

৯ নম্বর ওয়ার্ডে আগে কাজ করত মেসার্স বেল্লাল এন্টারপ্রাইজ। বর্তমানে সেখানে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। এ ছাড়া ৪ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছে এসএ করপোরেশন। এ প্রতিষ্ঠানের মো. মঞ্জুরুল আলমও বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত।

 

 

অন্যদিকে ডিএনসিসির ময়লার বাণিজ্য এখন দাদন হাওলাদার, জামাল হোসেন ও রাজু গাজী নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা প্রত্যেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া ধানমন্ডি এলাকার বর্জ্য সংগ্রহের কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকির হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ফারুক খানের প্রতিষ্ঠান। লালমাটিয়া এলাকার বর্জ্য সংগ্রহের কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সভাপতি এ বি এম গোলাম নোমানি।

 

 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বনানী, গুলশান ১ ও ২ নম্বর এলাকার বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহকারী সংগঠনগুলোর সমন্বয় করেন ১৯ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারণ সম্পাদক লিটন চন্দ্র ঘোষ এবং বনানী থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মামুন। এখানে এখন বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা কাজ পেতে মরিয়া।

সাড়ে চারশ কোটি টাকার ময়লা-বাণিজ্য হাত বদল