ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৯:২৪:২২ পিএম

৪৯ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকিতে ৫২০ কোটি টাকা জরিমানা!

৩ অক্টোবর, ২০২৪ | ১১:৩০ এএম

৪৯ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকিতে ৫২০ কোটি টাকা জরিমানা!

ছবি: সংগ্রহ

ছয় মাসে আমদানি হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন র সুগার বা চিনির কাঁচামাল।বন্ড সুবিধায় আমদানি করা এই র সুগারের ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৫২০ কোটি টাকা। এসব সুগার শুল্ককর পরিশোধ করে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ থেকে খালাস নেয়ার কথা। কিন্তু বন্ড কমিশনারেটকে না জানিয়ে অবৈধভাবে এসব র সুগার বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।

 

দেশের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী আব্দুুল মোনেমের আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড এই র সুগার খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে ৪৯ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে বিচারাদেশ দেয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকার (দক্ষিণ) কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন এই বিচারাদেশ দেন। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

 

অপরদিকে আব্দুল মোনেম গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানটির র সুগার অবৈধ অপসারণ ও শুল্ককর ফাঁকি যেন থামছেই না। প্রতিষ্ঠানটি এর আগে প্রায় ৫ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন র সুগার অবৈধভাবে অপসারণ করেছে; যাতে প্রায় ১ হাজার ২০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে। ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান ৫৩৩ কোটি টাকার শুল্ককর পরিশোধ করেছে। বাকি ৬৭৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার শুল্ককর পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। একইসঙ্গে আব্দুল মোনেম গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি স্থগিত, সুগারের উৎপাদন ও বাজারজাত স্থগিত করা হয়। পরে প্রতিষ্ঠান কিছু শুল্ককর পরিশোধ করায় হিসাব সচল করা হয়। তবে সেখানেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশির ভাগ টাকা পরিশোধ করা হয়নি বলে ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারেট সূত্র জানিয়েছে।

 

ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্র মতে, আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড বন্ড সুবিধায় আমদানি করা র সুগার অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পায় বন্ড কমিশনারেট। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ এপ্রিল কমিশনারেটের একটি প্রতিনিধিদল প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন করেন।

 

 

এ সময় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সহায়তায় ওয়্যারহাউজে মজুত কাঁচামাল বা র সুগার ইনভেন্টি করা হয়। এতে দেখা হয়, বন্ডেড ওয়্যারহাউজে কোনো র সুগার নেই। অথচ বন্ডেড হিসাব অনুযায়ী ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় ৬০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৪ দশমিক ৯৯ মেট্রিক টন র সুগার আমদানি করেছে। ২০২২ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত এই র সুগার আমদানি করা হয়েছে। এই র সুগারের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৯৭৮ কোটি ৭৯ লাখ ৫৬ হাজার ৮৯০ টাকা; যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর (কাস্টমস ডিউটি, রেগুলেটরি ডিউটি, ভ্যাট ও অগ্রিম কর) ৫২০ কোটি ৫৮ লাখ ৪ হাজার ৩৫০ টাকা।

 

সূত্র আরও জানায়, অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণ ও শুল্ককর ফাঁকি দেয়ায় চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ১১ মে লিখিত জবাব দেয়া হয়। যাতে বলা হয়, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা অপরিশোধিত চিনি গুদামজাত করা হয়। বন্ড লাইসেন্স প্রাপ্তির পর থেকে তাদের প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বন্ডিং সুবিধায় আমদানি করা সব কাঁচামাল চলমান মামলা ও কারণ দর্শানো নোটিশের আওতাভুক্ত হয়েছে।

 

ত্রর ফলে কারণ দর্শানো নোটিশে উল্লিখিত ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৪ দশমিক ৯৯ মেট্রিক টন র সুগার দেখানো হয়েছে। তাই অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডসহ যাবতীয় দলিলাদি সংগ্রহপূর্বক এ দপ্তর থেকে ইস্যু করা কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব তৈরি করা এবং দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ওয়্যারহাউজের ইনভেন্টিরি যাচাই-বাছাই প্রয়োজন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাদের সময় প্রয়োজন। নতুবা তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। নোটিশের জবাব ও ব্যক্তিগত শুনানিতে উপস্থিত হতে তাদের তিনমাস সময় প্রয়োজন। একই কারণ দেখিয়ে চলতি বছরের ২৩ জুন, ২৪ জুলাই ও ১৫ আগস্ট তিনবার সময় বৃদ্ধির আবেদন করা হয়।

 

সর্বশেষ ২৩ সেপ্টেম্বর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজি নাজমুল হাসান ও হেড অব কমার্শিয়াল আজিজুর রহমান চৌধুরী শুনানিতে উপস্থিত হন। শুনানিতে উপস্থিত বন্ড কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিষ্ঠান ৬০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি করা ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৪ দশমিক ৯৯ মেট্রিক টন র সুগার কোনো প্রকার এক্স বন্ড ছাড়াই বা শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই বা শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে ওয়্যারহাউজ থেকে খালাস করেছে।

 

সংশ্লিষ্ট বন্ড কর্মকর্তাকে অবগত না করেই এই কাঁচামাল অপসারণ করা হয়েছে। অবৈধ অপসারণ করায় লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ হয়েছে, যাতে সুদসহ প্রযোজ্য শুল্ককর আদায়যোগ্য। তবে শুনানিতে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লিখিত জবাব দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই কাঁচামাল অপসারণ করা হয়েছে। তারা দণ্ডারোপ না করার অনুরোধ জানান।

 

সূত্রমতে, বন্ড কমিশনার প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য, মামলার নথি, কারণ দর্শানো নোটিশ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পর্যালোচনা করেন। কাঁচামাল শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই অবৈধভাবে খালাস নেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কাস্টমস আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানকে ৪৯ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেন। একইসঙ্গে অর্থদণ্ড ও শুল্ককর হিসেবে প্রযোজ্য মোট ৫৬৯ কোটি ৫৮ লাখ ৪ হাজার ৩৫০ টাকা পরিশোধের জন্য ১৫ দিনের সময় দিয়ে বিচারাদেশ জারি করেছেন। তবে ফাঁকি দেয়া শুল্ককরের ওপর কাঁচামালের বন্ডিং মেয়াদ অনুযায়ী সুদ প্রযোজ্য হবে।

 

এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেমের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদেবার্তা পাঠানো হলেও জবাব দেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়া হলেও তিনি জবাব দেননি। একই বক্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজি নাজমুল হাসানের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করা হয়।

 

আমাদের হিসাবে আমরা সরকার রেগুলেটরি ডিউটি হিসেবে অনেক টাকা পরিশোধ করেছি, যা আমাদের এখন যে ডিমান্ড করা হয়েছেÑতার চেয়ে অনেক বেশি। কমিশনারেট কোনো হিসাব না করেই বিচারাদেশ দিয়েছে। আগের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার শুল্ককর বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি। বাকি টাকা আমাদের কিস্তি করে দিয়েছে। ব্যবসার অবস্থান ভালো নয়। সেজন্য বিলম্ব হচ্ছে।

৪৯ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকিতে ৫২০ কোটি টাকা জরিমানা!