ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ১১:৪৫:০৫ এএম

৫০ হাজার কিলোমিটার জরিপ হলেও কূপ খননের অবহেলায় গ্যাসের মজুদ বাড়েনি

১১ অক্টোবর, ২০২৪ | ১০:২৮ এএম

৫০ হাজার কিলোমিটার জরিপ হলেও কূপ খননের অবহেলায় গ্যাসের মজুদ বাড়েনি

ছবি: সংগ্রহ

আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকের শাসনামলে দেশের স্থলভাগ ও সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে জরিপ চালানো হয় প্রায় ৫০ হাজার লাইন কিলোমিটার (জরিপের অধীন এলাকার দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক) এলাকায়।

 

আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকের শাসনামলে দেশের স্থলভাগ ও সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে জরিপ চালানো হয় প্রায় ৫০ হাজার লাইন কিলোমিটার (জরিপের অধীন এলাকার দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক) এলাকায়। স্থানীয় গ্যাসের মজুদ খুঁজে বের করতে এ অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে টুডি, থ্রিডি ও মাল্টিক্লায়েন্ট জরিপের মাধ্যমে। তবে এ জরিপ কার্যক্রম দেশে গ্যাসের নতুন মজুদ বৃদ্ধিতে খুব সামান্যই ভূমিকা রাখতে পেরেছে। জরিপ চালানো হলেও গ্যাসের উত্তোলন বাড়াতে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস কূপ খনন করা হয়নি। দেশের মূল ভূখণ্ডের বাইরে ভোলা ছাড়া আর কোথাও গ্যাসের বড় কোনো মজুদ পাওয়া যায়নি।


জ্বালানি বিভাগের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে গ্যাস ক্ষেত্র ছিল ২৩টি। বর্তমানে তা ২৯টিতে উন্নীত হয়েছে। গত দেড় দশকে নতুন যে ছয়টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখানে গ্যাসের বড় কোনো মজুদ পাওয়া যায়নি। নতুন আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে নোয়াখালীর সুন্দলপুর গ্যাস ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ও নিশ্চিতকৃত মজুদ (টুপি-প্রুভেন অ্যান্ড প্রবাবল রিজার্ভ) ৫০ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। এছাড়া কুমিল্লার শ্রীকাইল গ্যাস ফিল্ডে মজুদ পাওয়া যায় ১৬১ বিসিএফ, রূপগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডে ৩৩ বিসিএফ, সিলেটের জকিগঞ্জে সামান্য কিছু গ্যাসের মজুদ পাওয়া যায়। এর বাইরে স্থলভাগের মূল ভূখণ্ডে ভোলা জেলায় ভোলা নর্থ ও ইলিশায় অন্তত ৮০০ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে। কিন্তু ভোলার এ গ্যাস এখন কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। পাইপলাইন না থাকায় তা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাচ্ছে না।


স্থল ও সাগরে গত ১৫ বছরে প্রায় ৫০ হাজার লাইন ও বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালানো হলেও সেখানে অনুসন্ধান কার্যক্রম পর্যাপ্ত মাত্রায় ছিল না বলে দাবি জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের। তাদের ভাষ্যমতে, গ্যাসের নতুন মজুদ আবিষ্কারের জন্য শুধু জরিপ পর্যাপ্ত নয়। এর সঙ্গে নতুন কূপ খননও প্রয়োজন। কিন্তু দেশের স্থলভাগে বিশেষ করে পশ্চিম অঞ্চল এবং পাহাড়ি এলাকায় আজ পর্যন্ত গ্যাসের কূপ খনন করা যায়নি। এসব এলাকায় কূপ খনন করা গেলে গ্যাসের মজুদ পাওয়ার বড় সম্ভাবনা ছিল বলে মনে করছেন তারা।

 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ‘দেশের যে পরিমাণ জরিপের তথ্য আছে পেট্রোবাংলার কাছে; তা দিয়ে কোথায় কোথায় এ সম্পদ আছে সেটি বোঝা যায়, বিশেষত স্থলভাগে। এ গ্যাসের মজুদ নিশ্চিত হতে এখন কূপ খনন করা প্রয়োজন। গত দুই দশক ধরে পাহাড়ি এলাকায় গ্যাসের কোনো অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো যায়নি। এটিও জরুরি ভিত্তিতে করা দরকার। বাপেক্সের সক্ষমতাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি এখানে কারিগরি সহায়তার প্রয়োজন হলে পেট্রোবাংলার বিদেশী কোম্পানিকে সংযুক্ত করতে পারে। সেটি করা গেলে বিপুল পরিমাণ সম্ভাবনা কিন্তু আছে।’

 

জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানে স্থলভাগে টুডি সিসমিক সার্ভে করা হয়েছিল ২০ হাজার ১৭ লাইন কিলোমিটার এলাকায়। এখন পর্যন্ত তা উন্নীত হয়েছে ৩২ হাজার ৩১৫ কিলোমিটারে (জুন ২০২৩ পর্যন্ত)। এ অনুযায়ী বিগত দেড় দশকে নতুন করে ১২ হাজার ৩৩৪ লাইন কিলোমিটার টুডি সিসমিক জরিপ করা হয়েছে।

 

সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গত দেড় দশকে জরিপ চালানো হয় ১২ হাজার ৯৩২ লাইন কিলোমিটার এলাকায়। এর মাধ্যমে মূলত গভীর সাগরে তেল-গ্যাস সম্পদ কেমন আছে, তা দেখার প্রয়াস চালানো হয়। এ জরিপের ওপর নির্ভর করে পেট্রোবাংলা সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে, যার কার্যক্রম এখন চলমান রয়েছে।

 

জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপুল পরিমাণ জরিপের তথ্য বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার হাতে থাকলেও মোটাদাগে তা কাজে লাগানো যায়নি। শুধু জরিপ নয়, এসব এলাকায় গ্যাসের মজুদ নির্ণয়ের জন্য গত দেড় দশকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কূপও খনন করা হয়নি। বরং গ্যাসের সহজ সমাধানের জন্য এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে।

 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বিইআরসির সাবেক সদস্য (গ্যাস) মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘গ্যাস অনুসন্ধানে অনেকগুলো জরিপ হয়েছে। বাপেক্স বিগত সময়গুলোয় এসব জরিপ করেছে। বিগত সরকারের সময়ে কিছু জরিপ হয়েছে। তবে শুধু জরিপ করে বসে থাকলেই হবে না, কূপ খনন করতে হবে। পেট্রোবাংলার উচিত আগামী তিন-চার বছর কতগুলো কূপ খনন করতে পারবে. সেটির একটা হিসাব করা। এরপর দ্রুত গ্যাস পেতে হলে বাকি জায়গাগুলোয় কূপ খনন করে তারা বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে খনন করতে পারে। ভোলায় যেসব কূপ খনন করে গ্যাস পাওয়া গেছে, সেগুলোকে প্রকৃতপক্ষে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র বলা যাবে না। এ গ্যাস ক্ষেত্রগুলো মূলত মূল্যায়ন ও উৎপাদন কূপ।’

 

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পেট্রোবাংলা নতুন করে ১০০ গ্যাস কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। বাপেক্সের রিগগুলো শতভাগ কাজে লাগিয়ে এসব কূপ খনন করা হবে। এজন্য আগামী ২০২৫ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে পেট্রোবাংলার নিজস্ব তহবিল এবং সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে এ সহায়তা পাওয়া গেলে শতভাগ সফল হওয়া সম্ভব।’

৫০ হাজার কিলোমিটার জরিপ হলেও কূপ খননের অবহেলায় গ্যাসের মজুদ বাড়েনি