ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৪:৩৮:৫৯ পিএম

‘টাকা ছেপে দুর্বল ব্যাংক বাঁচানোর দরকার নেই’

১৪ জুলাই, ২০২৪ | ১০:৫৪ এএম

‘টাকা ছেপে দুর্বল ব্যাংক বাঁচানোর দরকার নেই’

তারল্য সহায়তা দিয়ে দুর্বল ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেছেন, টাকা ছাপলেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে। মুদ্রানীতি কাজে আসবে না।

 

গতকাল শনিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন আহসান এইচ মনসুর।

 


ডলারের দাম বাজারভিত্তিক থাকলে এমনিতেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসবে বলে মনে করেন আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা। তাঁর মতে, টাকা ছাপা বন্ধের পাশাপাশি রেমিট্যান্সে আড়াই শতাংশ প্রণোদনাও বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ এই প্রণোদনা প্রকৃত রেমিট্যান্স প্রেরকরা পান না। হুন্ডিবাজদের পেটে যায়।

 


রেমিট্যান্স প্রণোদনা বন্ধ করলে ছয় হাজার কোটি টাকার অপচয় কম হবে। প্রণোদনাও দিতে হবে না। এই অর্থ অন্য খাতে ব্যবহার করা যাবে। দেশের স্বার্থে এখন তিনটি কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।

 


তিনি বলেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা এবং টাকা ছেপে ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করা উচিত। গত এক বছরে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কাজটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু বিশেষ তারল্য সহায়তার নামে কয়েকটি ব্যাংককে টাকা ছেপে ঋণ দিয়েছে। এমনটি চলতে থাকলে মূল্যস্ফীতি কমবে না।

 

আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে আাার্থিক দুরবস্থার কারণে দিন দিন বাংলাদেশ ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে।


এমনকি ধীরে ধীরে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে। অন্যদিকে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না সরকার। এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও নেই, ডলারও নেই। তাহলে এই বাজেট কিভাবে বাস্তবায়ন হবে? দেশের আর্থিক খাতের সংকট মোকাবেলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই।
জ্যেষ্ঠ এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। ব্যাংক খাতের দুর্বলতার কারণে এখন ব্যাংক ব্যক্তি খাতকেও ঋণ দিতে পারছে না। আবার সরকারকেও ঋণ দিতে পারছে না। এখন ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। এ বছর যদি বাড়ে, তাহলে সেটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে। সেই হিসাবে এ বছর আমানত আসবে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো।

 

নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ছে, তা কিভাবে দেবে ব্যাংক? সরকার এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে ব্যক্তি খাত টাকা কোথায় পাবে। কিন্তু বাজেটে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৭ শতাংশ। কিন্তু এ পর্যন্ত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যদি ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি না বাড়ে, আবার সরকারকে ঋণ দিতে হয়, তাহলে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কিভাবে অর্জন হবে?

 

দেশের স্বার্থেই এখন ব্যাংক খাতের সংস্কার খুবই জরুরি বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল, আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার আনা হবে। কিন্তু ছয় মাস পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এটা খুবই হতাশাজনক। আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে সেটা ভালো।

 

কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সংস্কার দরকার। আমরা তো আমানত খেয়ে ফেলেছি। এভাবে ব্যাংক কত দিন চলবে? ব্যাংক খাত নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। সেটা করতে হবে সরকারকেই। ব্যাংক খাতে আজকে যে এই অবস্থা হলো, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।’

 

ঋণ আদায় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংক। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। সরকারকে ট্যাক্সও দিচ্ছে। আসলে কোনো আয়-ই হয়নি। আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী। তাদের কারণেই এখন আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা।

 

লক্ষ করা যাচ্ছে, এত সমস্যার মধ্যেও লভ্যাংশ দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। এভাবে আর কত দিন ব্যাংক চলতে পারবে? অমানত শেষ হয়ে যাবে। গ্রাহকের অর্থ আর ফেরত দিতে পারবে না ব্যাংক।

 

আর্থিক খাতে সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হচ্ছে অভিযোগ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশের সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হয় আর্থিক খাতে। যেখানে সঠিক তথ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ১১ শতাংশ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে। বাস্তবে খেলাপি বা মন্দ ঋণ ২৫ শতাংশ।

 

ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। প্রবন্ধ উপস্থান করেন ইআরএফের জ্যেষ্ঠ সদস্য ওবাইদুল্লাহ রনি ও সানাউল্লাহ সাকিব। তাঁরা জানান, বর্তমান সরকারের সময় পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো অনেক বড় বড় প্রকল্প হয়েছে।

কিন্তু ডলার সংকট, ব্যাংক খাতে দুরবস্থার কারণে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে। সরকারের সব অর্জন যেন এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক খাতের দুরবস্থা ম্লান করে দিচ্ছে।

‘টাকা ছেপে দুর্বল ব্যাংক বাঁচানোর দরকার নেই’