ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
১ অক্টোবর, ২০২৪ | ৯:৪৪ এএম
অনলাইন সংস্করণ
রূপপুরের ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের সংকট
১ অক্টোবর, ২০২৪ | ৯:৪৪ এএম
ছবি: সংগ্রহ
দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে রাশিয়ার ঋণ পরিশোধে বাড়তি অর্থ গচ্চা দিচ্ছে বাংলাদেশ। পাঁচ বছর ধরেই এই বিষয় চলমান। দেশটির ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তিতে প্রয়োজনীয় শর্ত না থাকার কারণে বাড়তি এই ব্যয় গুনতে হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে থাকার দায় নিচ্ছেন না ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালকরা।
প্রকল্পে ধীরগতির কারণে অর্থ ব্যয় না হওয়ার অনুমোদিত ঋণের অঙ্গীকার ফি গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আটকে থাকা ঋণের সুদ যথাসময়ে রাশিয়াকে পরিশোধ করতে না পারলে ব্যয় আরো বাড়বে। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া ঋণ দিচ্ছে এক হাজার ১৩৮ কোটি মার্কিন ডলার (১১.৩৮ বিলিয়ন), যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি (ডলারপ্রতি ১২০ টাকা হিসাবে)। এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প। প্রকল্পটিতে রাশিয়ার দেওয়া ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার দেওয়া ঋণের চেয়ে রূপপুরে দেওয়া রাশিয়ার ঋণের সুদের হার দ্বিগুণ।
জানা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রাশিয়ার ঋণের সুদ ও অঙ্গীকার ফি পরিশোধের বিষয়টির এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। আর প্রকল্পের জেনারেল ডিজাইনার ও ঠিকাদার রোসাটম করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা ‘এটময়এক্সপোর্ট’ প্রকল্পের কাজে দেরি করলেও জরিমানা গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। তবে জরিমানার পরিমাণ কিছুটা কমতে পার।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তথ্য, ২০২০ সাল পর্যন্ত রাশিয়াকে ৭৪ লাখ ২০ হাজার ডলার বা ৭৮ কোটি টাকা জরিমানা দিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের জন্য ২৯ লাখ ২০ হাজার ডলার বা ৩১ কোটি টাকা দাবি করেছে রাশিয়া। অঙ্গীকার ফির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ হলে এর পরিমাণ কমবে। ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালের জন্য ফি দিতে হবে সাত লাখ ৫০ হাজার ডলার বা ৯ কোটি টাকা। কিন্তু বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ী এই তিন বছরের জন্য দিতে হবে ১০০ কোটি টাকা।
অভিযোগ উঠেছে, নির্মাণকাজে রাশিয়ার ঠিকাদার পিছিয়ে থাকলেও প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আগেভাগে কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। দায়িত্বে অবহেলার দায় না নিয়ে উল্টো দেশের জনগণের ওপর জরিমানার দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির শর্তও বাংলাদেশের জন্য অনুকূল নয়। এতেও
বিষয়টি সম্পর্কে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাশিয়ার ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে দেশটির ঠিকাদার। এই ক্ষেত্রে আমরা শুধু কাজের মান তদারকি করছি। প্রকল্পের কাজ করতে না পারার জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়। বরং আমরা রাশিয়ার ঠিকাদারকে কাজ দ্রুত করতে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। এই ক্ষেত্রে কাজে পিছিয়ে থাকলে তার দায় রাশিয়ার ঠিকাদারের। রাশিয়ার কাছে চাওয়ার পরে অনুমোদিত অর্থ ব্যয় না হলে তার ব্যর্থতার দায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঠিকাদারের। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ঋণের অনুমোদিত অর্থ যথাযথ সময়ে ব্যয় না হওয়ার অন্যতম কারণ কভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ তাদের ঋণের সুদ আলাদা করে রেখে দিয়েছে। তারা তাদের সমস্যার কারণে নিতে পারছে না। এর জন্য বাড়তি সুদ দাবি না করার বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত দুই দেশের সরকারের ঋণচুক্তি বা ইন্টার-গভর্নমেন্টাল ক্রেডিট অ্যাগ্রিমেন্টের (আইজিসিএ) দফা ২-এর অনুচ্ছেদ ৫-এ বলা হয়েছে, কোনো বছরে বাংলাদেশ যদি পূর্বনির্ধারিত পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশ সরকারকে ব্যয় না হওয়া অর্থের ০.৫ শতাংশ অঙ্গীকার বা কমিটমেন্ট ফি হিসেবে রাশিয়াকে দিতে হবে।
চুক্তি অনুযায়ী, নতুন পঞ্জিকা বছর (ক্যালেন্ডার ইয়ার) শুরুর ন্যূনতম ছয় মাস আগে প্রকল্পের ব্যয় ঠিক করবে দুই দেশ। অনুমোদিত অর্থ ব্যয় না হলে অঙ্গীকার ফি দিতে হবে। এই অর্থ দুই দেশের সম্মতির ভিত্তিতে মার্কিন ডলার অথবা অন্য মুদ্রায় বছর শেষের তিন মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হব
পিছিয়ে থাকার দায় নিচ্ছে না ঠিকাদার, রাশিয়ার ঠিকাদার কাজে বিলম্বের জন্য বৈশ্বিক করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইউরোপে ক্রয় আদেশ দেওয়া যন্ত্রপাতি সময়মতো সরবরাহ করতে না পারা—এসব বাস্তবতা এড়িয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানকে অজুহাত হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষে বলা হচ্ছে, নানা কারণে কাজে পিছিয়ে থাকার দায় কেন বাংলাদেশকে নিতে হবে? অঙ্গীকার ফি নামে কেন জরিমানা গুনতে হবে? এর দায় কোনোভাবে রাশিয়ান ঠিকাদার এড়াতে পারে না।
অন্তর্বর্তী সরকার গত আগস্ট মাসে রাশিয়াকে চলমান মূল ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানায়। এতে রাশিয়া প্রাথমিকভাবে রাজিও হয়। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইআরডি আগের ঋণচুক্তি কিছুটা সংশোধনে একটি খসড়া তৈরি করে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মতামত নেয়।
সম্পূর্ণ ঋণ পাওয়ার আগেই পরিশোধের চাপ : পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সম্ভব্যতা যাচাই সমীক্ষা করতে প্রথম দফায় ৩ শতাংশ সুদে ৫০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি হয় ২০১৩ সালে। ২০১৮ সাল থেকে ওই ঋণ পরিশোধ করা শুরু হয়। প্রথম চুক্তির আওতায় রাশিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য এক হাজার ২৬৫ কোটি ডলারের চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করে সাধারণ চুক্তি সই হয়। এই নির্ধারিত চুক্তিমূল্যের ৯০ শতাংশ বাবদ এক হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণের জন্য রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফায় মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ৪ শতাংশ সুদে নতুন ঋণ চুক্তি করা হয়। এই ঋণের এখন সুদ পরিশোধ করলেও মূল কিস্তি ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে শুরু হবে।
রূপপুর মূল প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত রাশিয়া বাংলাদেশকে ৭৭৮ কোটি ২৯ লাখ ৬৩ হাজার ৫০১ ডলার ঋণ দিয়েছে। আর চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন থাকায় ২০২২ সাল থেকে ঋণ পরিশোধ বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া বাংলাদেশকে বকেয়া অর্থ পরিশোধের জন্য চিঠি দিয়েছে। এতে এখন পর্যন্ত নেওয়া ঋণের বিপরীতে বকেয়া সুদ বাবদ ৬২ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার ডলার চেয়েছে দেশটি। প্রকল্পের ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে দুই বছরের জন্য ব্যবহৃত ঋণের বর্তমান স্থিতির ওপর আরো ৬০ কোটি ডলার অতিরিক্ত সুদ পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া অঙ্গীকার ফির বিষয়টিও রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রূপপুর প্রকল্পে শুধু এক বছর রাশিয়ার ঋণের অর্থ পুরোপুরি ব্যয় করা হয়েছে। ২০১৮ সালে পুরো ব্যয় হলেও ২০১৯ সালে ৪৯ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ৬৮ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে। আর ২০২১ সালে ১৮০ কোটি ডলার ঋণের ছাড়ের অনুমোদন হলেও ব্যয় ১৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার; ব্যয়ের হার ৭৩ শতাংশ। ২০২২ সালে ব্যয় করা হয়েছে ৫৪ শতাংশ। আর ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ অর্থ ছাড় করা হয়েছে। এই বছর ২৫০ কোটি ডলার ঋণছাড় অনুমোদন হলেও ব্যয় করা হয়েছে ১০৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এই ব্যয়ের হার মাত্র ৪৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে এই ঋণের অর্থে যন্ত্রপাতি আনার কথা থাকলেও তা আনা হয়নি। এর দায় ঠিকাদারের, কিন্তু জরিমানা দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
ঋণের মেয়াদ বাড়াতে শর্ত : নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারার কারণে রাশিয়া ঋণের মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাবের সঙ্গে কঠিন শর্ত দিয়ে চিঠি দিয়েছে, যা পূরণ করতে পারছে না বাংলাদেশ। দেশটির শর্ত হচ্ছে ঋণের বকেয়া, অঙ্গীকার ফি ও সুদের টাকার কিস্তি পরিশোধ করা হলেই এই সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।
নির্বাচনী প্রচারণার হাতিয়ার সর্ববৃহৎ প্রকল্প, সংশ্লিষ্ট বক্তিরা বলছেন, জনবহুল বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভৌগোলিক অবস্থান ও ব্যয় বিবেচনায় বিভিন্ন মহলের সমালোচনা থাকলেও তা আমলে নেয়নি তৎকালীন সরকার। সরকারের নির্বাচনী প্রচারণায় উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ব্যবহার করা হয়েছে। মেয়াদ শেষ হলেও এই প্রকল্প থেকে চলতি বছরেও কোনো বিদ্যুৎ উত্পাদনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
জনগণের অর্থের এই গচ্চা দিতে সায় দিয়ে এসেছেন সাবেক মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। আর তাঁর এসব কাজে প্রধান সহযোগী ড. শৌকত আকবর সব প্রকল্পের শুরু থেকেই প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সঙ্গে ২০১৫ সালে স্থাপিত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কম্পানির শুরু থেকেই তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গ করে আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ করে। আর রাশিয়ান ঠিকাদারে সঙ্গে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক উপপ্রকল্প পরিচালক ড. জাহেদুল হাসানকে প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পটি শুরু থেকে গত জুলাই পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৬৯.০১ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৭৪ হাজার ৯৮১ কোটি দুই লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৬.৩০ শতাংশ। প্রকল্পের যন্ত্রপাতি স্থাপন পুরোপুরি শেষ হয়নি। অথচ প্রকল্প চালুর নামে জ্বালানি আমদানি করা রাখা হয়েছে।