ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৫:০৯:০১ এএম

ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক

১৭ অক্টোবর, ২০২৪ | ৮:৩৯ এএম

অনলাইন সংস্করণ

সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রয়োজন প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কার

১৭ অক্টোবর, ২০২৪ | ৮:৩৯ এএম

সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রয়োজন প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কার

ছবি: সংগ্রহীত

অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে বিশ্ব অর্থনীতি বর্তমানে এক চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। রাজস্ব ও মুদ্রানীতিতে নজিরবিহীন শিথিলতা অবলম্বনের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতি যখন করোনা মহামারীর ধাক্কা সামলে উঠছিল ঠিক তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে পর্যুদস্ত করে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় পরিস্থিতি এবং আমেরিকা ও চীনসহ বহুপক্ষীয় বাণিজ্যযুদ্ধ বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্য প্রসারে বিরাট এক অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপীই বিশেষ করে ২০২২ সালের পর থেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যদিও আমাদের পার্শ্ববর্তী কিছু দেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশই বর্তমানে মূল্যস্ফীতির এ চাপ অনেকটাই সামলে নিয়েছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পতিত সরকারের ভ্রান্ত রাজস্ব ও মুদ্রানীতিই আমাদের দেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য পুরোপুরিভাবে দায়ী। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, কুচক্রী মহলের পরামর্শে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সময়মতো পর্যাপ্তভাবে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অবলম্বন না করা এবং সরকারের রাজস্বনীতিতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন করে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়িয়ে সার্বিক সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারার কারণেই সাম্প্রতিক কালে আমাদের দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে।

 


আশার কথা এই যে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী ড. আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। গত ১৩ আগস্ট দয়িত্ব গ্রহণের পর এরই মধ্যে কয়েক দফায় ব্যাংকের নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তিনি কতটা আন্তরিকতার দৃষ্টান্ত রেখেছেন এবং প্রয়োজনে নীতি সুদহার আরো বৃদ্ধির বার্তাও দিয়ে রেখেছেন। অর্থনীতির তাত্ত্বিক ধারণা অনুযায়ী নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয় এবং আমাদের দেশে এ অপেক্ষার সময় সাত থেকে নয় মাস পর্যন্ত লাগতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারের রাজস্বনীতিতে বাজেটের ঘাটতি হ্রাস এবং উৎপাদন ও কর্মসংস্থানমুখী খাতে পর্যাপ্ত ব্যয় বাড়ানোরও কোনো বিকল্প নেই। অর্থাৎ সরকারকে একদিকে যেমন অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমাতে হবে, অন্যদিকে তেমনি কর্মসংস্থানমুখী উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় ও রাজস্ব আয় বাড়াতে উদ্যমী ভূমিকা পালন করতে হবে।

 


দুঃখজনক হলেও সত্যি যে গণ-অভ্যুত্থানে পতিত সরকার জাতীয় সংসদে যে বাজেট পাস এবং বাস্তবায়ন শুরু করে গছে, সেখানে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত বাজেটের মোট আকার ৯ লাখ ৯২ হাজার কোটি থেকে কমিয়ে ৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করা সত্ত্বেও উন্নয়ন বাজটের প্রায় সম্পূর্ণটাই ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে অর্থায়নের ব্যবস্থা করে গেছে। এমনকি অপ্রদর্শিত আয়কে মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফিরিয়ে আনার অনৈতিক চেষ্টার পরও উন্নয়ন বাজেটের প্রায় পুরোটাই অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে গত সরকার, যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করার বিধান বাতিল এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা স্থগিত রাখার বিষয়ে এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে|

 

 

বিগত সরকার ঘাটতি বাজেট অর্থায়নের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা নিট ঋণ গ্রহণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা নগদ তারল্যের চাপে থাকা ব্যাক খাত ও মুদ্রা নীতির জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যের সঙ্গে পুরোপুরিই সাংঘর্ষিক। সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডগুলোর ইল্ড এবং ব্যাংকগুলো কর্তৃক আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদের হার এরই মধ্যে বৃদ্ধি পেয়ে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে সরকারের সঞ্চয় স্কিমগুলোর বিদ্যমান সুদহার না বাড়ালে এক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র নতুন ইস্যুর চেয়ে পূর্বের ইস্যুকৃত সঞ্চয়পত্র বেশি ভাঙানোর ফলে নিট ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ঋণাত্মক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, যা ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরো বাড়িয়ে দেবে বলেই প্রতীয়মান হয়। এছাড়া চলতি অর্থবছর বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের সরবরাহ ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি না পেলে বাজেটে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা মোট রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করাও দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতায় ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে অর্জন করা সম্ভব হবে না বলেই ধারণা করা যায়।|প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা বলতে শুধু যে জনবলের অভাব ব্যাপারটা সে রকম নয়। সুশৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়ম বা অবকাঠামোর মধ্যে না আনলে কোনো দেশেই মানুষ তার নিজের অর্জিত আয়ের অংশ কর হিসেবে স্বেচ্ছায় সরকারের আয়ের হিসাবে জমা করতে চায় না। যে দেশের মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় বা আর্থিক লেনদেনের হিসাব যত বেশি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সে দেশের জিডিপির শতকরা হিসাবে রাজস্ব আয়ের পরিমাণও তত বেশি। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই যে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে আমাদের দেশের অবস্থান একেবারেই পেছনের সারিতে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও জিডিপির শতকরা অংশ হিসেবে আমাদের দেশের রাজস্ব কর আদায়ের অনুপাত সবচেয়ে কম।|বহুকাল ধরে ভ্যাট সংগ্রহে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) স্থাপনের কথা আমরা শুনে আসছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ইএফডি স্থাপনের অগ্রগতি খুবই নগণ্য। এমনকি চাইলেই আমাদের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা-বাণিজ্যের সর্বত্র রাতারাতি ইএফডি স্থাপন করা সম্ভব নয়, যদিও এই একটিমাত্র উপায়ে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানো সম্ভব বলে ধারণা করা হয়। আবার আমাদের রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা মূলত পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল, যার চাপ সমাজের ধনী-গরিব সবার ওপরই প্রায় সমভাবে পড়ে।

 

 

 

সরাসরি রাজস্ব আদায় বাড়ানোর সবচেয়ে বড় উপায় হলো আয়কর, যা সমাজে একটি নির্দিষ্ট সীমার ওপরে আয় উপার্জনকারী জনসমষ্টির ওপর প্রযোজ্য এবং সমাজের ধনী-গরিবের মধ্যে বিদ্যমান আয়বৈষম্য কমিয়ে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের কল্যাণ বৃদ্ধির সহায়ক। কিন্তু আয়কর সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে দেশে এক কোটিরও বেশি মানুষের করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাত্র ৪৩ লাখ মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সর্বশেষ প্রকাশিত ‘শিডিউলড ব্যাংকস স্ট্যাটিসটিকস’-এর তথ্যানুযায়ী, গত ৩০ জুন দেশে চার লাখ বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ টাকা আছে এমন ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যাই রয়েছে ৬৪ লাখের বেশি। এমনকি ওই হিসাব থেকে সরকারি বা খানার বাইরের হিসাবগুলো বাদ দিয়ে ৪ লাখ বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ টাকা রয়েছে দেশে এমন ব্যক্তিগত হিসাবধারীর সংখ্যাও দাঁড়ায় ৬২ লাখ ৫৪ হাজারের বেশি। মহিলা ও ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতা ব্যতীত করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার ধরা হলে দেশে আয়কর প্রযোজ্য ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা আরো বেশি হবে বলেই প্রতীয়মান হয়। সাধারণত ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত টাকা ব্যক্তির অনেক বছরের পুঞ্জীভূত আয় ও আয়কর তার এক বছরের আয়প্রবাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে গণ্য করা হলেও উপরোক্ত তথ্য থেকে দেশে আয়কর রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা যে মোটেও সন্তোষজনক নয় তার একটা তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শুধু শহরে নয়, এমনকি দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়ও এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা নিজেদের টাকায় অবৈধ পন্থায় বৈদেশিক মুদ্রা কিনে তাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে লেখাপড়া করাচ্ছেন, অথচ দেশের নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে ন্যূনতম পরিমাণে আয়কর দেয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই ভাবনাতেই আনছেন না। কাজেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে বা নতুন টাকা না ছাপিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানোর যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। আর রাজস্ব আয় বাড়াতে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা-বাণিজ্যের সর্বত্র দ্রুত ইএফডি স্থাপনসহ ভ্যাট প্রদানের ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণের একটা সুপরিকল্পিত রূপরেখা প্রণয়ন ও তা জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের পাশাপাশি আয়কর থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতেও গতানুগতিক পথে না হেঁটে কার্যকর ও উদ্ভাবনীমূলক পন্থা অবলম্বন করাও এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।

 

 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জনবলের সীমাবদ্ধতার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারের রাজস্ব আয়ের আওতা বাড়াতে কর এজেন্ট নিয়োগের বিষয়টি সাম্প্রতিককালে বেশ আলোচিত হলেও এর তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। কর এজেন্ট নিয়োগের বিষয়টি কিছুটা আইনি কাঠামোর সঙ্গে জড়িত বিধায় এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সঙ্গেও জড়িত বলে ধারণা করা যায়। এছাড়া কর এজেন্ট নিয়োগ দিলে অভিজ্ঞতার বিচারে কর বিভাগের সাবেক কর্মকর্তারাই এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এতে আয়কর বিভাগের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা অনৈতিক যোগসাজশ সৃষ্টির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এজেন্ট নিয়োগ করতে গেলে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত স্বীকৃতি/গ্যারান্টি দিতে হতে পারে। তাই এ দীর্ঘসূত্রতা ও নানা জটিলতা পরিহার করে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় বাড়াতে অস্থায়ী ও পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে এনবিআরের অধীনে একটি প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা ভেবে দেখা যেতে পারে। প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের আওতায় প্রতি আয়কর বছরের সেপ্টেম্বর হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত বা সুবিধাজনক অন্য কোনো সময়ে তিন-চার মাসের জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কিছু ছেলেমেয়েকে বা শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীকে উপজেলা/এলাকাভিত্তিক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে মাঠ পর্যায়ে নতুন আয়কর দাতা ও ভ্যাট প্রদানকারী খুঁজে বের করা ও তাদের স্বেচ্ছায় কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করে টিন নম্বর প্রদান, রিটার্ন ফর্ম পূরণ ও দাখিলের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং স্বেচ্ছায় প্রদত্ত কর আদায় শেষে তৎক্ষণাৎ আয়কর সনদ প্রদানের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য যে বর্তমানে দেশের সুনির্দিষ্ট কিছু স্থানে আয়কর মেলা আয়োজনের মাধ্যমে এ ধরনের সেবা প্রদান করা হলেও সেখানে নতুন করদাতারা যেতে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় কর সেবাকে ভ্রাম্যমাণ করে মানুষের দোরগোড়ায় গিয়ে শুধু নতুন করদাতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায় এবং এ প্রকল্পের আওতায় সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত লোকবলের দৈনিক মজুরি/বেতন-ভাতাকেও তাদের পারফরম্যান্সের সঙ্গে বা নতুন করদাতা শনাক্তকরণ ও তাদের দ্বারা শনাক্তকৃত নতুন করদাতার কাছ থেকে কর আদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যায়। এতে একদিকে যেমন ব্যয়সাশ্রয়ী উপায়ে করের আওতা বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে তেমন দেশে কর প্রদান বিষয়ে প্রশিক্ষিত জনবলের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। আবার মহৎ এ কাজে অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত ছাত্র-ছাত্রী বা শিক্ষিত বেকার জনগণও অল্প কিছু দিন কাজ করে তাদের লেখাপড়া বা জীবন-জীবিকার একটা বড় অংশ নিজেরাই বহন করার পথ খুঁজে পাবে। তবে অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত লোকবলের মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম স্থানীয় প্রশাসন ও আয়কর-সংশ্লিষ্ট কর্মকতাদের মাধ্যমে এমনভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে যাতে তারা জোরপূর্বক কর আদায় করে সরকারের ভাবমূর্তি কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না করে। এছাড়া এ ধরনের প্রকল্পের কাজ মাঠ পর্যায়ে শুরুর পূর্বেই জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানোরও প্রয়োজন হবে।

 

 

 

বিগত সরকারের আর্থিক খাতের ব্যাপক দুর্নীতি ও ভ্রান্ত এবং অপরিণামদর্শী রাজস্ব ও মুদ্রানীতির কারণে বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোয় নগদ তারল্যের অভাব ও মুদ্রাবাজারে সুদের হারের ঊর্ধ্বমুখী ধারা সৃষ্টি হয়েছে। তারল্য সংকটের পাশাপাশি দেশে অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় আবশ্যিকভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংককে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির আশ্রয় নিতে হচ্ছে। তবে এমন সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির মধ্যেও ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এমন মুন্সিয়ানা দেখাতে হবে যাতে দেশের সার্বিক উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উন্নয়ন বাজেটের ঘাটতি ও ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ হ্রাস এবং রাজস্ব আয় বাড়াতে গতানুগতিক পথে না হেঁটে প্রযুক্তিনির্ভর ও উদ্ভাবনী চিন্তার প্রসার ঘটাতে হবে। এক্ষেত্রে ছাত্র ও বেকার জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে রাজস্ব আয় বাড়াতে অস্থায়ী ও পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে এনবিআরের অধীনে পরীক্ষামূলকভাবে এ নিবন্ধে বর্ণিত প্রকল্প গ্রহণও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

 

 

মো. জুলহাস উদ্দিন: পিআরএলে অবস্থানরত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস অ্যান্ড অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপে খণ্ডকালীন অধ্যাপনায় সম্পৃক্ত

সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রয়োজন প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কার